বাংলাভয়েস.নিউজ
ক্যালিগুলা সিজার পাগলাটে এক রোমান সম্রাট। নৃশংসতার পাগলামি এবং হিংস্রতার জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তার আসল নাম ছিল গায়াস জুলিয়াস সিজার জার্মানিকাস।
১২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট রোমের সিজার ক্লডিয়ান পরিবারের নতুন সদস্য হিসেবে জন্ম নেন গায়াস সিজার। এই গায়াস সিজার পরবর্তীতে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম পাকাপাকিভাবে লিখিয়ে নেন রোমের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এবং অত্যাচারি শাসক হিসেবে। তিনি যখন জন্ম নেন তখন রোমের সম্রাট ছিলেন তার মহা পিতামহ অগাস্টাস সিজার।
ক্যালিগুলার জন্মের দু’বছর পর ১৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয় সম্রাট অগাস্টাস সিজারের। অগাস্টাসের মৃত্যুর পূর্বেই প্রায় আধ-ডজন উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর পর তখন বেঁচে ছিলেন তার সৎপুত্র টাইবেরিয়াস। তিনি ক্ষমতা টিকে রাখতে হত্যায় মত্ত হয়ে উঠেন। তবে কিশোর বয়সের ক্যালিগুলাকে মেরে সময় এবং শক্তির অপচয় করতে চাননি সম্রাট। ক্যালিগুলা বেঁচে থাকেন তার দাদি অ্যান্টোনিয়ার সাথে। এই সময়ে ক্যালিগুলার মাঝে কিছু অসামঞ্জস্য ব্যবহারের লক্ষণ দেখা যায়।
একজন রাজকুমার হয়ে বন্দি অপরাধীর ন্যায় জীবনযাপন ক্যালিগুলার মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলে। বন্দিদের অত্যাচারের দৃশ্য দেখে পৈচাশিক আনন্দ লাভ করতেন ক্যালিগুলা।

ক্যালিগুলা সিজার এর রোমান মুদ্রা
৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলেন টাইবেরিয়াস। সম্রাটের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি হিসেবে রোমের মসনদে আসীন হলেন গাইয়াস ক্যালিগুলা সিজার। কিন্তু এই মৃত্যু নিয়েও নানা গুজব রটিত হয়েছিলো। অনেকের মতে, সম্রাট অচেতন হয়ে পড়লে ক্যালিগুলা তাকে মৃত ভেবে নিজে সম্রাটের রাজ আংটি আঙুলে পরেছিলেন। আর এর মাধ্যেমে রক্তবাজ উন্মাদ এক যৌনাচারী শাসকের সিংহাসনে আসীন হন ক্যালিগুলা সিজার।
রোমান সিংহাসনে আসীন হয়ে এই উন্মাদ সম্রাট নতুন ফরমান জারি করে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সকলের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পাগলামির চূড়ান্ত দেখিয়ে তিনি বন্দিদের পিতামাতার চোখের সামনে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার হুকুম দেন। জল্লাদখানা অসহায় পিতামাতার কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো।
ক্যালিগুলা সিজার ঘোড়ার দৌড়ে একবার বাজি ধরেছিলেন। তার দল হেরে যায়। বিপক্ষ বিজয়ী দলের যারা আনন্দ করেছিল তাদের সবাইকে তিনি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। সম্রাটের বাজির ঘোড়া হেরে গেছে। একথা সম্রাট একদমই মেনে নিতে পারছেন না। তাই তার মেজাজ বিশেষ ভালো নেই। তার উপর জনতার আনন্দ দেখে তার গা জ্বলতে লাগলো। তিনি তার উপদেষ্টাকে কাছে ডাকলেন। ডেকে ফরমান জারি করলেন, কাউকে যেন ময়দান ছেড়ে বাড়ি যেতে না দেওয়া হয়। সম্রাটের নীল দলের বিপক্ষে বাজি ধরা সকলকে আজ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। ময়দানের বাদামি ধূলা সেদিন আর্দ্র হয়ে উঠলো নিরীহ জনতার রক্তপাতে।
তার জন্মদিন ভুলে যাওয়ার অপরাধে দুই উপদেষ্টাকে কতল করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, অনেক ইতিহাসবিদ ধারণা করেন, কিশোর বয়সে তিনি তার বোন দ্রুসিলার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হন। নিরীহ জনতাকে ধরে ক্ষুধার্ত সিংহের খাঁচায় ভরে দিতেন এই উন্মাদ রাজা।
বেহিসাবি ক্যালিগুলা সিজার রাজস্ব ঘাটতি মোকাবেলায় সিদ্ধান্ত নেন তিনি রাজপতিতালয় খোলার। সেখানে ১৪ বছর বয়সী তরুণী থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা পর্যন্ত সব রাজকীয় নারীদের বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে হবে দুই সপ্তাহের জন্য। যৌন বিকারগ্রস্ত জনতা লুফে নিলো সম্রাটের এই প্রস্তাব। অনেক নারী সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। কিন্তু এখানেও লাভ হলো সম্রাটের। তিনি আত্মহত্যার অপরাধে সেই পরিবারের পুরো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে দেন। শূন্য রাজকোষাগার আবার ভরে উঠে অর্থের ঝনঝনানিতে।

ক্যালিগুলা সিজারের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ
ক্যালিগুলা ছিলেন ভয়ানক যৌন বিকারগ্রস্থ।অবাধ যৌন সংসর্গের ফলে তিনি নিউরোসিফিলিস নামে এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন যা তার মৃত্যু পর্যন্ত টিকে ছিলো।এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ভয়াবহ রকমের যৌন বিকৃতি দেখা দেয়। যা ক্যালিগুলার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। অসংখ্য অভিজাত শ্রেণীর সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের স্ত্রী কন্যাদের সাথে তাঁদের স্বামীদের সম্মুখেই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন তিনি।
রোমের সেই ভারী বাতাসকে আরো ভারী করতে ক্যালিগুলা ঘোষণা করলেন, তিনি আর মানুষ নন, একজন দেবতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। এখন থেকে রোমে তার পূজাও করতে হবে।
মাত্র চার বছরের মাথায় ক্যালিগুলার অত্যাচারে সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেলো কতিপয় সিনেটর এবং সেনা কর্মকর্তার। তাই তারা পরদিনই খেলার ময়দানে ক্যালিগুলাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেন। ক্যালেন্ডারের পাতায় ৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি একটি খেলার অনুষ্ঠানে একজন দেহরক্ষী প্রথম ক্যালিগুলাকে ছুরিকাঘাত করে বসে। এরপর মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন প্রিটোরিয়ান রক্ষী ক্যালিগুলাকে ঘিরে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। ইতিহাসবিদদের মতে, মোট ৩০ বার তাকে ছুরিকাঘাত করার মাধ্যমে হত্যা করা হয়। ক্যালিগুলার নাম এবং বংশ চিরতরে রোমের মাটি থেকে মিশিয়ে দিতে তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরও হত্যা করা হয়। তার মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আর এভাবেই শেষ হয় এক নৃশংস উন্মাদের নিষ্ঠুরতার যবানিকাপাত।
ক্যালিগুলা রোমান ইতিহাসের এক কলঙ্কিত নাম, অন্ধকার যুগের প্রতীক।
ক্যালিগুলা নামে একটি সিনেমা আছে। যে সিনেমাতে এই বিষয়গুলো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
বি.ভ/এন.এম