বাংলাভয়েস.নিউজ
ডিসেম্বর আমাদের অহংকার, মহান বিজয় দিবস। রক্তস্নাত ত্যাগে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতার বিজয়গাঁথায় লিখা জানা-অজানা লক্ষ আত্মত্যাগের কাব্য। তেমনি এক বীর নায়ক নাদের মিয়া, আমাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নাদের গুন্ডা।
পড়ালেখা বেশি দূর করতে পারেনি, বখে যাওয়া একজন হিসেবেই সমাজে তার পরিচয়। পুরান ঢাকার মালিটোলায় তার বসবাস, সেখানকার লোকজন তাকে অপছন্দ করে, আবার খানিকটা ভয়ও পায়। পাড়ার সবাই একনামে চেনে তাকে, তার ধমকে এলাকার কুকুর-বিড়াল এক ড্রেনের পানি খায়। শুধু বংশাল মহল্লার লোকজন নয়, আশেপাশের মহল্লার লোকেরা দেখেছে নাদের গুন্ডার কাছে বিস্তর পিস্তল, রাইফেল যেমনি আছে তেমনি একটা মেশিনগানও আছে। সত্য সত্যই সে মাস্তানি করত।
পঁচিশে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট, ঢাকা শহরটা রক্তের স্রোতে স্নান করে দেয়া এক ভূতুড়ে জনপদ বানিয়েছে পাক আর্মি। পঁচিশে মার্চ সকালে বন্ধু দুলুর (চিত্রনায়ক ফারুক) সঙ্গে দেখা করেছিল নাদের। শ্যামলীতে দুলুদের বাসা, সেই বাসার পেছনের একটা বাঁশঝাড়ের পেছনে একটা ওপেল গাড়ি নিয়ে আসে নাদের, ডাক দেয় দুলুকে। গাড়ির বনেট খুলে দিলো সে, দুলু অবাক হয়ে দেখে, সেখানে বেশ কয়েকটা রাইফেল আর পিস্তল। নাদের দুলুকে আসন্ন বিপদের আভাস দেয়। এরপর নাদের সেখান থেকে বের হয়ে তার সহযোগী অন্যান্যদের সংগঠিত করে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। এরইমধ্যে শুরু হয়ে যায় পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পেয়ে নাদের আর দেরী করেনি। ধোলাইখালে পুরনো ট্রাকের বডি পড়ে ছিল বেশ কয়েকটা সেগুলোকে টেনে রাস্তায় এনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। এরপর নিজেদের পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। পাকিস্তান আর্মির কনভয় বংশালে ঢোকার সাথে সাথে নাদের এর মেশিনগান গর্জে ওঠে। পাক আর্মিদের বুট জুতার গমগম করা আওয়াজ ছাপিয়ে একঝাঁক বুলেটে একজন, দুজন, তিনজন করে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটা খাকি শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পিছিয়ে যায় পাক আর্মি।
নাদেরর আক্রমণে হায়েনার মতো ক্ষিপ্ত পাকি আর্মিরা শক্তি সঞ্চয় করে ঝাপিয়ে পড়ে বংশাল, নয়াবাজার, আবুল হাসানাত রোড, কাজী আলাউদ্দিন রোডের বিভিন্ন বাড়িতে তান্ডব চালাতে থাকে। প্রথম দিকে তাদের টার্গেট শুধু হিন্দু বাড়ির প্রতি হলেও প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ায় তারা নির্বিচারে বাড়ি-ঘরে আগুন দিতে থাকে। সে যাত্রা নাদের পালিয়ে গেলেও পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় তার গেরিলা অপারেশন অব্যাহত রাখে। নাদেরর অস্ত্রের যোগানদাতা ছিলা সংগ্রাম নামে এক পাঞ্জাবী। অর্থের বিনিময়ে এসব অস্ত্র সংগ্রহ করে দিত।

বন্ধুদের আড্ডায় নাদের
পুরান ঢাকার রাজাকারদের কাছে তখন নাদের গুন্ডা বা তার বাহিনীর নামটাই মূর্তিমান আতঙ্ক! মে মাসের শেষদিকের কথা। বর্ষাকাল শুরু হবে হবে করছে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় শান্তি কমিটির দালালদের মধ্যে প্রধান একজন খাজা খায়েরউদ্দিনের সভায় হামলা চালাবে বলে ঠিক করলো নাদের। কিন্ত গোলা-বারুদ তো চাই। যুদ্ধ শুরুর আগে নাদের গুন্ডা অস্ত্র কিনতো সংগ্রাম নামের এক লোকের কাছ থেকে।
যথাসময়ে সংগ্রাম হাজির হয় অস্ত্রের চালান নিয়ে। কিন্তু নাদেরের ওয়াচ গার্ডরা দেখতে পেল অস্ত্র নিয়ে আসছে সংগ্রামের লোকজন নয়, পাক আর্মিরা। সাথে সাথে নাদের সংগ্রামকে গুলি করে মেরে ফেলে।
ততক্ষণে পাকিস্তান আর্মিরা চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। নাদের তার বাহিনী নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। নাদের-হারুণ দুই সহোদর এবং বন্ধু সোহরাব পাক আর্মির ওপর গুলি চালিয়ে বাকিদের কভার দেয়। একপর্যায়ে হারুণ ও সোহরাবকে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখে নাদের সড়ে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দেয়াল টপকানো অবস্থাতেই পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় সে। আহত নাদের আশ্রয় নেন বেচারাম দেউড়ির বস্তিতে।
চারিদিকে চিরুনী অভিযান করতে করতে পাক আর্মিরা বস্তিতে হাজির হয়। বস্তির লোকজন জানের ভয়ে আহত নাদেরকে ধরিয়ে দেয়। নাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। পাক আর্মির বর্বর নির্যাতনের মুখেও নাদের নিজের ও সহযোগীদের পরিচয়ের বিষয়ে মুখ খোলেনি।
পুরান ঢাকায় নাদের গুণ্ডার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল গ্যাদা নামের এক ছোটখাটো গুণ্ডা। নাদেরের কারণে সেভাবে কাজকর্ম কিছুই করতে পারতো না সে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পরে সে যোগ দিয়েছিল শান্তি কমিটিতে। সেখানে গেদা সনাক্ত করে নাদেরকে। সেনারা উল্লসিত হয়, পৈশাচিকভাবে গেদার সামনেই হত্যা করে নাদেরকে যার বিবরণ পুরা বংশাল জুড়ে প্রচার করে গেদা। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে পুরানো ঢাকার পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকারদের আতঙ্ক নাদেরের। গেরিলা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নাদের গুন্ডা’র ভাগ্যে বীরত্বের জন্য কোনো খেতাব জোটেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়ও তার নাম নেই। কোনো বিজয় উৎসবে ধ্বনিত হয় না নাদেরর নাম।
বিখ্যাত গায়ক, সুরকার লাকী আখন্দ বলেছিলেন, বিশ্বাস করুন নাদের কিছু পাবার আশায় যুদ্ধে যায়নি, নাদের আপনার জন্য, আমার জন্য, আমাদের জন্য, এই দেশের আপামর নারী-পুরুষের জন্য, এই দেশের ঐ প্রানপ্রিয় পতাকার জন্য গিয়েছিল। ৭১ এর মার্চের আগেও যে নাদের পাপী, গুন্ডা, বদমাশ ছিল অথচ তার স্মৃতিতে এখনো পুরান ঢাকার অনেক মানুষের চোখ আদ্র হয়, ঋণী মনে করে, এটাই নাদেরের বড় পাওয়া।
পুরান ঢাকা নাদের গুন্ডার জন্যে বিখ্যাত হবার কথা ছিল। অথচ নাদের গুন্ডাকে কেউ মনে রাখেনি। আসুন শ্রদ্ধাভরে স্মরন করি জাতির সেই মহানায়কদের আত্মত্যাগকে, যাদের বদৌলতে আমরা পেয়েছি আমাদের এই বাংলাদেশ।