বাংলাভয়েস.নিউজ
উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া বা তাপমাত্রা করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে। ফলে বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশে করোনা আতঙ্কের মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখছেন সংক্রামক বিশেষজ্ঞরা।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষক কাশিম বুখারিসহ বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং আবহাওয়ার দুটি মানদণ্ড তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ভিত্তিতে পরিস্থিতি যাচাই করেছেন।
এসএসআরএনএ এই গবেষণার যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২২ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের যে যে অঞ্চলে সার্স-কোভ-২ ছড়িয়েছে, সেসব অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৩ থেকে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। গবেষকেরা আরও বলছেন, ওই অঞ্চলে প্রতি ঘনমিটারে ওই আবহাওয়ায় আর্দ্রতা ছিল ৪ থেকে ৯ গ্রাম। এমআইটির বিজ্ঞানীরা বলছেন, আক্রান্ত দেশগুলোর গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
থাইল্যান্ডের চুয়ালালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজির সহকারী অধ্যাপক পোকারথ হানসসূতা এএফপিকে প্রায় একই কথা জানান। তিনি জানান, আবহাওয়া উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে ভাইরাসের বিস্তার কমতে পারে বলে কিছু প্রমাণ রয়েছে। তবে সূর্যের আলোয় করোনা মরবে এমন ঘটনাকে তিনি গুজব বলেছেন।
শনিবার, ০৪ এপ্রিল বাংলাভয়েস এর নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা যায়, মৃত্যুপুরী ইতালিতে গত ২৪ ঘন্টায় মারা গিয়েছে ৭৬৬ জন এবং সেখানকার গড় তাপমাত্রা ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মৃত্যুর মিছিলের সারথী ইউরোপের অপর দেশ স্পেনে একদিনে মৃত্যু ৫৪৬ জন এবং সেখানকার বর্তমান তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
২ লক্ষ ৭৮ হাজার ৭৯৬ জন সংক্রমিতকে নিয়ে কোভিড-১৯ ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে মৃত্যু হওয়া শহর নিউইর্য়ক সিটির তাপমাত্রা আজ ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ফ্রান্স, ইরান ও জার্মানিতে এখন পর্যন্ত যথাক্রমে ৬৫০৭, ৩৪৫২ এবং ৫৬০১২৯৫ জন মারা গিয়েছে। এই তিন দেশের গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ১২, ৯ ও ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
যুক্তরাজ্যে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে সর্বমোট ৪৩১৩ জন। দেশটির এপ্রিল মাসের গড় তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এছাড়া সুইজারল্যান্ড ৬২০ জন, বেলজিয়াম ১২৮৩ জন, নেদারল্যান্ডস ১৬৫১ জন, তুরস্কে ৪২৫ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৭৭ জন ও পর্তুগালে ২৬৬ জন মারা গিয়েছে। এই ছয় দেশের মধ্যে তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও পর্তুগালে গড় তাপমাত্রা ১৩-১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। আর অন্য তিনটি দেশের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নীচে।
যদিও ব্রাজিলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গিয়েছে ৩৬৫ জন, যখন সেখানকার তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মালয়েশিয়ায় এখন পর্যন্ত মারা গিয়েছে ৫৭ জন এবং সেখানকার তাপমাত্রা গড়ে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভারতে সর্বমোট মারা গিয়েছে ৮৬ জন এবং সেখানকার বর্তমান তাপমাত্রা গড়ে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন চিকিৎসায় ইউরোপ থেকে পিছিয়ে থাকা এমন ঘনবসতিপূর্ন দেশসমূহে তাপমাত্রা ও আদ্রতার প্রভাবে কিছুটা সংক্রমনের হার কমেছে।
স্পেনের মাদ্রিদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল সায়েন্সের গবেষক মিগুয়েল আরুজোর বক্তব্য, মানুষের শরীরের বাইরে ভাইরাসের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে জলবায়ু অবশ্যই একটি ভূমিকা রাখে। সার্স কোভিড-২ (করোনাভাইরাস) বিশ্বের যেসব অঞ্চলে এবার দ্রুত ছড়িয়েছে, তার সবই শীতপ্রধান এলাকা।’
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস এবার সেসব অঞ্চলেই বেশি ছড়িয়েছে, যেসব অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ৫ থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার এসব এলাকায় আর্দ্রতাও কম।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর, বি) ভাইরোলজি ল্যাবরেটরির প্রধান মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশ্বের সব ভাইরোলজিস্ট বলছেন, এটা নভেল ভাইরাস। সেখানে তাপমাত্রা কোনো বিষয় না। আমিও তাঁদের সঙ্গে একমত। তবে প্রবণতা বলছে ঠান্ডার প্রকোপ যেখানে বেশি সেখানে অপেক্ষাকৃত বেশি ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। কিন্তু এখানে তাপমাত্রা কোনো ভূমিকা রেখেছে কি না, তা বলা এখন অসম্ভব।’
করোনাভাইরাস মানুষের শ্বাসনালিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কোষকে দখলে নিয়ে নিজের আরও লাখ লাখ সংস্করণ তৈরি করে ফেলে। আর উপসর্গ প্রকাশিত হওয়ার আগেই সে আরও মানুষকে সংক্রমিত করে ফেলে। ইতালিতে এ ভাইরাসের আরএনএতে তিনটি নিউক্লিওটাইড পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে এটি মানুষের জন্য আরও মারাত্মক হয়ে পড়েছে। তবে ভারতে উন্মোচিত জিনগত বৈশিষ্ট্য থেকে আশাবাদী হয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অঞ্চলে ইউরোপের মতো ক্ষতি না–ও হতে পারে।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণা বলছে, আক্রান্ত দেশগুলোর গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৪ থেকে ৯ গ্রাম। আর এশিয়ার যে দেশগুলোয় বর্ষা মৌসুম আছে, সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়তো কম হবে। কারণ, এই অঞ্চলে প্রতি ঘনমিটারে আর্দ্রতার পরিমাণ ১০ গ্রাম পর্যন্ত।
জানা গেছে, চীনের পরপরই তাদের প্রতিবেশী হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তিনটি দেশই করোনার ব্যাপক বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এর মধ্যে গোটা দুনিয়ার সঙ্গে এশিয়ার যোগাযোগের হাব হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাপুর। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪৯ জন, যার মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন। এতে আশাবাদী হয়ে তাঁরা বলছেন, চীন থেকে ইউরোপ ঘুরে ভাইরাসটি দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছে। এর মধ্যে জিনগত পরিবর্তনের কারণে এটি দুর্বল হয়েছে। এ অঞ্চলের উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কাজ করেছে করোনার বিস্তারের প্রতিকূলে।
ভারতের পদ্মভূষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক জি পি নাগেশ্বর রেড্ডি সে দেশের গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, চীন ও ভারতে ভাইরাসটির জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করা হয়েছে। ইতালিতে ছড়ানো ভাইরাসের সঙ্গে ভারতে ছড়ানো ভাইরাসের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভারতের ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে কিছু কিছু জিনগত পরিবর্তন হয়েছে, যা আশার আলো দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশে গতকাল ৩ এপ্রিল আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে ফরিদপুরে ৩৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি, সীতাকুণ্ডে ৩৬ দশমিক ১ ডিগ্রি, রাঙ্গামাটিতে ৩৭ ডিগি এবং কক্সবাজারে ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। বাতাসে আদ্রতার পরিমান ছিল ৬১%।
দেশে করোনাভাইরাসে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০ জনে। আক্রান্তদের মধ্যে আরও দুজন মারা গেছেন। ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ জনে।
বি.ভ/এন.এম